Select Page

সুইডেনের ব্যাংক

May 8, 2021 | জীবন যাপন, ব্যাংক

দেশ হিসেবে সুইডেন ছোট হলেও এর অর্থনীতি অনেক শক্ত। আর একারনেই সুইডেনে ব্যাংক আছে অনেক ধরনের। বলা যায় দুনিয়ার সর্বাধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা আছে এই সুইডেনে। আবার অন্যদিকে বলা যায় সুইডেনের ব্যাংক হলো দুনিয়ার সবচেয়ে অদ্ভুত।

১. সুইডেনের ব্যাংকের সংখ্যা কত ?৫ টি নাকি ১০ টি নাকি আরো বেশি। সুইডেনে ব্যাংক আছে অনেক, প্রায় শতাধিক। এক হিসাবে এর মোট সংখ্যা ১১৪ টি।

২. চোখের দেখা ব্যাংক কয়টি ?সুইডেনে ব্যাংকার সংখ্যা অনেক হলেও বাস্তবে এদের বেশিরভাগ অদৃশ্য। অর্থাৎ কাগজে কলমে আছে তবে বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। সহজ করে বলি , অনেক ব্যাংক শুধু অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এদের কোনো অফিস বা কাউন্টার নেই, যেখানে গিয়ে সরাসরি কথা বলতে বা সেবা নিতে পারবেন !

৩. ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংক !!সুইডেনের ব্যাংক গুলি একটির সাথে অন্যটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাই একটি ব্যাংকে বসেই অন্য ব্যাংকের লেনদেন করাও সম্ভব !!!এছাড়া কিছু কিছু ব্যাংক তাদের বিশেষ কার্যক্রম চালানোর জন্য আলাদা করে লাইসেন্স নিয়েছে। ফলে একটি ব্যাংকের মধ্যেই একাধিক ব্যাংক থাকে। Swebank এর সবচেয়ে বড় উদাহরন। এদের নিজেদের অনেকগুলি ব্যাংক লাইসেন্স আছে।

৪. ব্যাংক ঋণসুইডেনের প্রতিটি ব্যাংক থেকেই ব্যাংক ঋন দেয়া হয়। ব্যক্তিগত ও বানিজ্যিক ঋন এর প্রক্রিয়া ও ঋনের সুদের হার বিভিন্ন। যে কেউ একাধিক ব্যাংক থেকেও ঋন নিতে পারেন। বাসা কিনতে চাইলে সেক্ষেত্রে ঋনে সুদের হার সবচেয়ে কম। সাধারনত মাত্র ২% থেকেও কম সুদের হার থাকে। নতুন গাড়ি কিনতে ২ থেকে ৮ % সুদের হার থাকে।

৫. UC বা kreditupplysning ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সব ব্যাংকের তথ্য ভান্ডার হিসেবে কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সরকারি ট্যাক্স অফিস থেকে শুরু করে অনেকগুলি সরকারি অফিসের সরাসরি যোগাযোগ আছে। এই প্রতিষ্ঠানের কাছেই আছে আপনার গত কয়েক বছরের সকল ব্যাংকিং কাজের বা আয় ব্যায়ের হিসাব। সুতরাং যে কোনো ব্যাংক আপনাকে ঋন দেবার আগে , এই প্রতিষ্ঠান থেকে আপনার ইতিহাস জেনে নেয়। এবং মুলত সেই ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে ঋনের সুদ নির্ভর করে। এছাড়া বড় কোনো কেনাকাটা বা লেনদেন করার আগেও অনেক প্রতিষ্ঠান ,,এই প্রতিষ্ঠান থেকে আপনার ইতিহাস জেনে নেয়।সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানে আপনার খারাপ রিপোর্ট থাকলে সুইডেনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাবে।

৬. ব্যাংক নাকি দোকান ?ইকা (ICA) হলো সুইডেনের সবচেয়ে বড় মুদি দোকান বা চেইন শপ। এদের দুই হাজারের বেশি দোকান আছে। মজার ব্যাপার হলো এদের আছে ব্যাংক হিসেবে লাইসেন্স। তাই এদের প্রতিটি দোকানের ক্যাশ কাউন্টার এক একটি ব্যাংক কাউন্টার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। টাকা জমা / তোলা এবং বিল দেয়া ইত্যাদি সব কাজই করা যায়।

৭. সুইস বা Swish : এটি হলো একটি মোবাইল এপ। এটি সরাসরি আপনার মোবাইলের সাথে ব্যাংক একাউনের সংযোগ স্থাপন করে। ফলে এই এপ দিয়ে সীমিত আকারে টাকা দেয়া বা নেয়া যায়। এই এপের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো , শুধু মোবাইল নম্বর জানা থাকলেই টাকা দেয়া সম্ভব। আলাদা করে যাকে টাকা দিবেন তার ব্যাংক একাউন্ট জানার দরকার নেই। সুইডেনের প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের সাথেই এই “সুইস” এপ ফ্রি তেই ব্যবহার করা যায়। এটি অনেকটাই বাংলাদেশের বিকাশ এর মত।

৮. মোবাইল ব্যাংক আইডি : এটি বিশেষ ধরনের একটি প্রোগ্রাম। এটি আসলে একটি ডিজিটাল আই ডি বা E-legitimation , যেটি আপনার ব্যাংক আপনাকে দিবে। এটি আপনি যে ডিভাইস বা মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করেন , সেটিতে বিশেষ ব্যবস্থায় চালু করা হয়। তাই সিম কার্ড না ,,বরং আপনার মোবাইল সেটটি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আপনি একটি পিন নম্বর বা আঙুলের ছাপ দিয়ে এপটি চালু করবেন। এর সুবিধা হলো , এই এপ দিয়েই আপনি সুইডেনের যে কোনো ব্যাংক বা সরকারি অফিস এবং অনেক বেসরকারি ওয়েব সাইটে লগ ইন করতে পারবেন। ফলে আলাদা করে কোনো একাউন্ট বা পাসওয়ার্ড লাগবে না। মোবাইল ফোন সেট পরিবর্তন করলে আবার নতুন করে এই প্রোগ্রাম সেট আপ করতে হবে।

৯. ব্যাংক একাউন্টের খরচ কত ?বিভিন্ন ব্যাংকের খরচ বিভিন্ন রকম। মোটামুটি ০০ থেকে ৪০ ডলার বাৎসরিক ফি নিতে পারে। তবে ছাত্র হলে সাধারনত সব ব্যাংকে ফ্রি একাউন্ট খোলা যায়। এছাড়া কার্ড এবং ইন্সুরেন্স ইত্যাদি অনুযায়ী খরচের তারতম্য হতে পারে।

১০. ব্যাংক কার্ড , ডেবিট নাকি ক্রেডিট ?ডেবিট কার্ড : আপনার ব্যাংকের একাউন্টের কার্ড। এই কার্ড দিয়ে সব কেনাকাটা করতে পারবেন। ভিসা, মাস্টারকার্ড বা মেস্ট্রো কার্ড হয়। সব গুলি দিয়েই ইন্টারন্যাশনাল কেনাকাটা করা যায়। বাংলাদেশের মত ঝামেলা নেই। আলাদা করে বাৎসরিক চার্জ থাকতে পারে।ক্রেডিট কার্ড : সাধারনত চাকরি বা নির্দিষ্ট আয় না থাকলে দেয় না। ভিসা বা মাস্টারকার্ড কার্ড হয়। সব গুলি দিয়েই ইন্টারন্যাশনাল কেনাকাটা করা যায়। বাংলাদেশের মত ঝামেলা নেই। আলাদা করে বাৎসরিক চার্জ নেই। কার্ড ভেদে ১ থেকে ৩ মাস এর মধ্যে ফেরত দিলে সুদ দিতে হয় না। একজন সুইডেনের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে একাধিক ক্রেডিট কার্ড নিতে পারে। অনেকেই ৪/৫ টি ক্রেডিট কার্ড থাকে। ক্রেডিট কার্ডে ৫০০ থেকে ১০ হাজার ডলারের সমপরিমান টাকা থাকে।

১১. ক্যাশ লেনদেনঅবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে , সুইডেনের ব্যাংকগুলি ক্যাশ টাকা লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। তাই চাইলেও এমনকি আপনার একাউন্টে টাকা থাকলেও ব্যাংকে গিয়ে ক্যাশ টাকা তুলতে পারবেন না এবং টাকা জমাও দিতে পারবেন না। টাকা তুলতে বা জমা দিতে এটিএম মেশিন ব্যবহার করতে পারেন। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যাংকে এখনো শর্তসাপেক্ষে কিছু লেনদেন সম্ভব !

১২. বিদেশে বা দেশে টাকা পাঠানো।আপনার যদি বৈধ আয় থাকে , তবে আপনি যে কোনো পরিমান টাকা দুনিয়ার যেকোন দেশে পাঠাতে পারবেন। কোনো ঝামেলা হবে না। অন্যদিকে আপনার একাউন্টে বড় কোনো পরিমান টাকা জমা পরলে , আপনাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে। সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পরলে , টাকা বাজেয়াপ্ত এমনকি জেল জরিমানা হতে পারে।সরাসরি একাউন্ট থেকে অথবা বিভিন্ন এজেন্সি এর মাধ্যমেও বাংলাদেশে যে কোনো পরিমান বৈধ টাকা পাঠাতে পারেন। তবে বাংলাদেশ থেকে বৈধ চ্যানেলে সুইডেনে টাকা আনা অনেক অনেক কঠিন বা প্রায় অসম্ভব। তবে ছাত্র অবস্থায় বাংলাদেশে স্টুডেন্ট ফাইল থেকে সুইডেনে টাকা আনা যায় তুলনামূলক সহজে।

১৩. অনলাইনে কেনাকাটাবেশিরভাগ সুইডেনের যে কোনো ব্যাংক কার্ড দিয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কেনাকাটা করা যায়। তবে কিছু ব্যাংকে বা কার্ডে মোবাইল এপ দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটা নিয়ন্ত্রন করা যায়। ইউরোপের বাহির থেকে কিছু কিনলে আলাদা করে টোল বা ট্যাক্স দিতে হতে পারে , এজন্য সুইডেনের কেউ সাধারনত কম মূল্য পেলেও চীন থেকে কিছু কিনতে চায় না।

১৪. ইন্সুরেন্স :প্রতিটি ব্যাংক একাউন্ট বা কার্ডের জন্য ইন্সুরেন্স থাকে। ফলে কার্ড হারিয়ে গেলে বা কেউ টাকা চুরি করে নিলে , সেটি আবার ফেরত পাওয়া যায়। এছাড়া অনেক কার্ডে ভ্রমন ইন্সুরেন্স থাকে , যেটা খুব কাজে লাগে। তবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকে বা কার্ডে ইন্সুরেন্স সুযোগ সুবিধা এর তারতম্য রয়েছে।

১৫. কাস্টমার কেয়ারঅনেক ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার ফোনে ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। তাই যখন খুশি ফোন করে সাহার্য্য নেয়া সম্ভব। ফোন করে ব্যাংকিং লেনদেন করা যায়।

১৬. ব্লক বা জবাবদীহিসন্দেহজনক যে কোন কিছু পেলে , সাথে সাথে একাউন্ট ও কার্ড ব্লক বা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে ফোন করে একাউন্ট ও কার্ড চালু করা যায়। এছাড়া আইনত ব্যাংক যে কোন লেনদেনের ব্যাখ্যা চাইতে পারে।

১৭. ট্রেনিংছাত্র থেকে শুরু করে অন্যকেউ ব্যাংকের নতুন কাস্টমার হলে , ব্যাংক নিজ উদ্যোগেই একটি ফ্রি ট্রেনিং দিয়ে থাকে। তবে সব ব্যাংকে এই সুবিধা নেই।

১৮. বন্ড, শেয়ার মার্কেট এবং পেনশনবন্ড, শেয়ার মার্কেট এবং পেনশন ইত্যাদির জন্য একাউন্টের মধ্যেই আরো একটি একাউন্ট খুলতে হয়। তবে মাত্র কয়েক মিনিটেই এগুলি করা যায়। এরজন্য আলাদা করে কোন কাগজ লাগে না।

১৯. বাচ্চাদের একাউন্টবর্তমানে ১৮ বছরের কমবয়সী যে কেউ ব্যাংক একাউন্ট খুলতে পারে। তবে অভিভাবক মূল দায়িত্বে থাকে। বাচ্চা আলাদা করে একাউন্ট নম্বর , সুইস এবং ব্যাংক কার্ড পায়। এগুলি সব ফ্রী। তবে লেনদেনে অনেক শর্ত থাকে। বাচ্চাদের একাউন্টে অনলাইন কেনাকাটার সুযোগ সাধারণত থাকে না।

২০. কোন ব্যাংক ভালো ?SEB (Skandinaviska Enskilda Banken), Swedbank, Handelsbanken, Nordea, Länsförsäkringar bank, ICA Banken এবং ফরেক্স ইত্যাদি ব্যাংকের কাউন্টার আছে নানা শহরে। ব্যাংক নয় বরং ব্যাংকের অফিসারের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই যেখানে ভালো ব্যাংক অফিসার পাবেন , সেখানেই একাউন্ট খুলুন।

২১. ব্যাংক একাউন্ট খুলার জন্য কি কি দরকার ?সুইডিশ পারসন নম্বর থাকলে, সেটির কাগজ এবং পাসপোর্ট দিয়েই ব্যাংক একাউন্ট খুলা সম্ভব। তবে অনেক সময় ব্যাংক আরো নানা কাগজ চাইতে পারে।সুইডিশ পারসন নম্বর না থাকলে, একাউন্ট খুলা খুবই কঠিন। নানা কাগজপত্র দেখে সন্তুষ্ট হলে তবে সাময়িক একাউন্ট খুলা যেতে পারে তবে তারও গ্যারান্টি নেই।

সাবধানতা : সুইডেনে অনেক প্রতারক ফোন করে ব্যাংক নিয়ে নানা কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আমার পরামর্শ হলো, ফোনে কোনো ব্যাংকিং তথ্য কাউকে দিবেন না অথবা ফোনে কোনো লেনদেন করা থেকে বিরত থাকুন। কারন ফোনে আপনি “হ্যা” বললে সেটি সুইডিশ আইনে কাগজে সই করে দেয়ার মতই কার্যকর।
তথ্যগত ভুল থাকতে পারে, সঠিক তথ্য পেলে বা কিছু বাদ পরে গেলে পরে এডিট করে ঠিক করে দিবো !

সকল বিষয়