সুইডেনের স্কুল জীবন নার্সারি থেকে এস এস সি
সুইডেনে বাচ্চারা সত্যিকার স্কুলে যাওয়া শুরু করে ৬ বা ৭ বছর বয়স থেকে। শুরুতে যে ক্লাশে যায় সেটার নাম এফ ক্লাশ পুরো নাম হলো Förskoleklass। এরপরে ক্লাশ ১ থেকে শুরু করে ক্লাশ ৯ পর্যন্ত হলো স্কুল। বাংলাদেশের মত মোট ১০ বছর স্কুলে পড়ালেখা করতে হবে। বাংলাদেশে যেমন প্রাইমারি এবং মাধ্যমিক দুইটি ধাপ আছে। সুইডেনে স্কুলে এরকম ৩ টি ধাপ আছে।
প্রথম ধাপ এটি র সুইডিশ নাম lågstadiet এটি হলো শুরুর এফ ক্লাশ (নার্সারি) থেকে ক্লাশ ৩ পর্যন্ত। ক্লাশ ৩ এ গিয়ে প্রথম একটি অফিসিয়াল পরীক্ষা হবে। সেটির নাম জাতীয় পরীক্ষা ক্লাশ ৩ (Nationella prov i årskurs 3)। স্কুলে অনেক বিষয়ে পড়ালেখা করলেও জাতীয় পরীক্ষা হবে মাত্র ২ টি বিষয়ে। এগুলি হলো সুইডিশ ভাষা এবং অংক। অন্য কোন বিষয়ে কোন জাতীয় পরীক্ষা হবে না। মজার বিষয় হলো একদিনে পরীক্ষা নেয়া হয় না। ২ মাস ধরে অল্প অল্প করে পরীক্ষা নেয়া হয়। লিখিত এবং মৌখিক দুইভাবেই পরীক্ষা নেয়া হয়। তবে পরীক্ষার ফলাফলে শুধু পাস্ এবং ফেল দেয়া হয়।
দ্বিতীয় ধাপ এটি র সুইডিশ নাম mellanstadiet এটি হলো ক্লাশ ৪ থেকে ক্লাশ ৬ পর্যন্ত। এর মধ্যে ক্লাশ ৪ এবং ৫ এ কোন অফিসিয়াল পরীক্ষা থাকবে না। ক্লাশ ৬ এ গিয়ে একটি অফিসিয়াল পরীক্ষা হবে। সেটির নাম জাতীয় পরীক্ষা ক্লাশ ৬ (Nationella prov i årskurs 6)। পরীক্ষা হবে মাত্র ৩ টি বিষয়ে। এগুলি হলো সুইডিশ ভাষা, ইংলিশ এবং অংক। কেউ অসুস্থ্য থাকলে বা কোন কারনে পরীক্ষা দিতে না পারলে তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় আবার পরীক্ষা দেবার সুযোগ দেয়া হয়। পরীক্ষার ফলাফলে A থেকে F গ্রেড দেয়া হয়। A হলো চূড়ান্ত ভালো এবং F মানে হলো ফেল। ক্লাশ ৬ এ জাতীয় পরীক্ষার ছাড়াও স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাশ পরীক্ষা নেয়া হয়। সেমিস্টার শেষে চিঠি বা পোস্টের মাধ্যমে বাবা মা এর কাছে সকল পরীক্ষার ফলাফল বাসায় পাঠানো হয়।
তৃতীয় ধাপ এটি র সুইডিশ নাম högstadiet এটি হলো ক্লাশ ৭ থেকে ক্লাশ ৯ পর্যন্ত। এর মধ্যে ক্লাশ ৭ এবং ৮ এ জাতীয় পরীক্ষা থাকবে না শুধু স্কুল পরীক্ষা হবে। ক্লাশ ৯ এ গিয়ে চুড়ান্ত স্কুল পরীক্ষা + জাতীয় পরীক্ষা হবে। জাতীয় পরীক্ষা ক্লাশ ৯ এর সুইডিশ নাম Nationella prov i årskurs 9। সুইডিশ ভাষা , বায়োলজি/ ফিজিক্স / কেমেস্ট্রি, ইংলিশ, ভূগোল/ইতিহাস/ধর্ম/ সমাজ এবং অংক বিষয়ে জাতীয় পরীক্ষা হবে। ক্লাশ ৯ এ জাতীয় পরীক্ষার ছাড়াও স্কুলে ১৪ টি বিষয়ে ক্লাশ পরীক্ষা নেয়া হয়। এগুলোর ফলাফল A-F গ্রেডে প্রকাশ করা হয়। সেমিস্টার শেষে চিঠি বা পোস্টের মাধ্যমে বাবা মা এর কাছে সকল পরীক্ষার ফলাফল বাসায় পাঠানো হয়।
জাতীয় পরীক্ষা ক্লাশ ৯ সুইডিশ নাম Nationella prov i årskurs 9 কে আমাদের দেশের মেট্রিক বা এস এস সি পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। এই পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই মূলত কলেজ (gymnasium) এ ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মত সুইডেনে স্কুলে সাইন্স, আর্টস বা কমার্স এরকম কোন ভাগ নেই।
সুইডেনের সকল স্কুলে একাডেমিক বছর শুরু হয় আগস্ট মাসে এবং শেষ হয় পরের বছর জুন মাসে। জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সব স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকে। ছাত্র শিক্ষক সবাই এই দুইমাস সময় ছুটি ভোগ করে। এছাড়া ষ্টার (påsklov) এপ্রিলে এক সপ্তাহ স্কুল বন্ধ থাকে এবং ক্রিসমাস এ ডিসেম্বরের শেষে প্রায় ৩ সপ্তাহের ছুটি থাকে। স্কুল ছুটির সময় ব্যতীত অন্য সময় মানে স্কুল চলাকালীন সময়ে বাচ্চাকে নিয়ে ২ সপ্তাহের বেশি সুইডেনের বাহিরে কোথাও যেতে চাইলে স্কুল থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় স্কুল থেকে বাচ্চার অনুপস্থিতির তথ্য ট্যাক্স অফিস এবং সরকরি ইন্সুরেন্স অফিস পেয়ে যায়। ফলে পরবর্তীতে আইনগত নানা ঝামেলায় পরতে পারেন।
সকল বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। মূল স্কুল সময় হলো মূলত সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত। নার্সারি থেকে শুরু করে ক্লাশ ৬ পর্যন্ত বাচ্চার যে সব অভিভাবক চাকরি বা পড়ালেখা করেন ,,,উনারা চাইলে বাচ্চাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬ তা পর্যন্ত বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৬ টা পর্যন্ত হলো “ডে কেয়ার”। “ডে কেয়ার” এ বাচ্চা রাখলে একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকাও দিতে হয়। ক্লাস ৭ থেকে ৯ পর্যন্ত বাচ্চাদের “ডে কেয়ার” এ রাখার সুযোগ নেই।
সুইডেনে সকল স্কুল এর পড়ালেখা নিয়ন্ত্রন করে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান তার নাম skolverket
সুইডেনে সরকারি স্কুলের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি স্কুল আছে। সরকারি বা বেসরকারি যাতেই ভর্তি করুন ,,পড়ালেখা মূলত ফ্রি।
বড় শহর গুলিতে কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকলেও বেশিরভাগ ছোট শহরে এরকম সুযোগ নেই।
সরকারি বা বেসরকারি অথবা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সবাইকে skolverket থেকে দেয়া অভিন্ন আইন মেনে চলতে হয়।
স্কুলে পড়ালেখার জন্য কোন টাকা পয়সা দিতে হয় না। এমনকি বেসরকারি স্কুলেও পড়ালেখার জন্য কোন টাকা পয়সা দিতে হয় না। (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) বেসরকারী স্কুলগুলি সরকারি স্কুলের মত সরকারি টাকা অনুদান হিসেবে পেয়ে থাকে।
বই খাতা পেন্সিল রবার ইত্যাদি মূলত স্কুল থেকেই দিয়ে দেয়া হয়। এগুলি ফ্রি। তবে বাচ্চাদের পোশাক/ হেলমেট / জুতা ইত্যাদি এর খরচ অভিভাবক কে বহন করতে হয়।
স্কুলে থাকার পুরোটা সময় সকল প্রকার খাবার স্কুল থেকেই সরবরাহ করা হয়। তাই প্রতিটি স্কুলে খাবার কেন্টিন আছে। এটাও ফ্রি। মুসলিম বাচ্চাদের জন্য বা যাদের এলার্জি আছে , তাদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এটাও ফ্রি।
বাসার আশেপাশে স্কুল হলে বেশিরভাগ বাচ্চা একা অথবা দলবেঁধে পায়ে হেঁটেই স্কুলে যায়, একটি দূরে হলে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। যাদের বাসা কয়েক কিলোমিটার দূরে তাদের জন্য স্কুল থেকে বিশেষ পরিবহন অথবা বাসের টিকিট দিয়ে দেয়া হয়। এটাও ফ্রি।
পরীক্ষায় পাশ ফেল না, বরং ক্লাশের শিক্ষক নিজ বিবেচনায় নির্ধারন করেন কে উপরের ক্লাশে যাবে নাকি আরো এক বছর একই ক্লাশে থাকবে !! ফলে ২/৩ টি বিষয়ে ফেল করার পরেও অনেকে উপরের ক্লাশে পড়ালেখা শুরু করতে পারে। এমনকি স্কুলের শেষে ১৪ টি বিষয়ের পরীক্ষায় মাত্র ৯ টি বিষয়ে পাশ করলেই ,,একজন ছাত্র কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারে।
শহর ভেদে এমনকি একই শহরের স্কুল ভেদে অনেক পার্থক্য থাকে স্কুলের পড়ালেখায়।
স্কুলে প্রায় সব ক্লাশেই পড়া লেখা ক্লাশেই সব করা হয় ফলে “বাসার কাজ” সাধারনত দেয়া হয় না। মাঝে মাঝে কিছু ক্লাশে বাসার কাজ দেয়। এছাড়া স্কুলের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে পারে না। তবে প্রায় সব স্কুলেই কোচিং সেন্টার (läxhjälp) আছে। যে ছেলে বা মেয়ে পড়া লেখায় খারাপ করতেছে শুধু তারাই এই কোচিং সেন্টারে এক্সট্রা ক্লাশ করতে পারে। এটিও ফ্রি। তবে সব স্কুলে সব ক্লাশে কোচিং সেন্টার নেই।
আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে ক্লাশ ৫ পর্যন্ত বাচ্চাদের পড়ালেখা নিয়ে সুইডেনে টেনশন করার কিছু নেই। স্কুলেই সব কিছু করে দেয়া হয়।
স্কুলে একটি ক্লাশ সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট থেকে এক ঘন্টা মেয়াদি হয়। ক্লাশে হোয়াইট বোর্ড অথবা প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া খাতা কলম এর ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি বাচ্চাকে স্কুল থেকেই একটি করে আই প্যাড অথবা কম্পিউটার দেয়া হয়। এটাও ফ্রি।
বাচ্চাদের পড়ালেখা অনেকটাই ডিজিটাল করা হয়েছে। একটি বিশেষ ওয়েব সাইট এ পড়ালেখার সব খবর দেয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে সেই ওয়েবসাইটে আগামী সপ্তাহে স্কুলে ঐ ক্লাশে কি কি করানো হবে তার বিবরন দেয়া থাকে।
স্কুলে ব্যায়াম এর ক্লাশ করা বাধ্যতামূলক সবার জন্য। এরপর ব্যায়াম শেষে সবাইকে গোসল করতে হয়। এরজন্য অতিরিক্ত কাপড় গামছা জুতা ইত্যাদি লাগে।
এছাড়া স্কুল থেকে নানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। বনে জঙ্গলে থেকে শুরু করে মিউজিয়াম সব জায়গাতেই নিয়ে যাওয়া হয়।
স্কুলে আবার খেলাধুলার নানা ব্যবস্থা থাকে। স্কেটিং থেকে শুরু করে আইস হকি , ফুটবল নানাবিধ খেলার সুবিধা বা ট্রেনিং দেয়া হয়।
ক্লাশ ৬ এ সাঁতার বাধ্যতামূলক। কেউ সাঁতার কাটতে না পারলে বিশেষ ব্যবস্থায় সাঁতার শিখানোর ব্যবস্থা করা হয়।
কাঠের কাজ এমনকি সুই সুতার কাজ বাধ্যতামূলক ভাবে শিখানো হয়। ফলে অনেক বাচ্চা স্কুলেই চেয়ার টেবিল বানানো শিখে ফেলে। ছোটখাট চেয়ার বা টুল বানালে সেটি বাচ্চাকে দিয়ে দেয়া হয় ফলে সে সেটি বাসায় নিয়ে যেতে পারে।
সুইডেনে বসবাসকারী প্রবাসীদের বাচ্চারা যেন তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা ভুলে না যায় , সেজন্য প্রতিটি ক্লাশে সপ্তাহে ১ দিন একটি ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টার মাতৃভাষা ক্লাশ নেয়া হয়। সুইডেনে বাংলা মাতৃভাষার বেশ কিছু শিক্ষক রয়েছেন। ক্লাস ৬ থেকে ৯ পর্যন্ত মাতৃভাষার ক্লাশ থেকেও A থেকে F গ্রেড দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে এই মাতৃভাষা ক্লাশ করা বাধ্যতামূলক না, তবে যারা মাতৃভাষা ক্লাশ করে এরা খুব সহজে ভালো কলেজে ভালো বিষয়ে ভর্তি হতে পারে। কারন মাতৃভাষায় পাওয়া নম্বর অতিরিক্ত নম্বর হিসেবে বিবেচিত হয়।
সুইডেনের যে কোন স্কুলে শিক্ষকতা করতে চাইলে “শিক্ষক লাইসেন্স” লাগবে। এই লাইসেন্স না থাকলে কেউ খন্ড কালীন কাজ করতে পারলেও চাকরি স্থায়ী কখনো হবে না।
সুইডেনে পড়তে আসা কারো বাচ্চা থাকলে, তাদের স্কুলে ভর্তির নিয়ম।
সুইডিশ পার্সন নম্বর ছাড়া কারো সুইডেনের কোন স্কুলে পড়ালেখা করা সম্ভব না। তাই এই পার্সন নম্বর পাবার পরে স্থানীয় পৌরসভা বা কমুনে ভর্তির আবেদন করতে হবে। এরপর সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যেই একটি স্কুলে ভর্তির সুযোগ দেয়া হবে। এরপর বাচ্চাটির একটি পরীক্ষা নেয়া হবে , বাস্তবে ঠিক পরীক্ষা নয় বরং আলোচনা। এরপর সেই স্কুল সিদ্ধান্ত নিবে কোন ক্লাশে বা কিভাবে সেই বাচ্চাটি পড়ালেখা শুরু করতে পারবে।
যাদের কোন মতেই পার্সন নম্বর পাওয়া সম্ভব না ,,,তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থায় পৌরসভা এবং ট্যাক্স অফিস মিলে বাচ্চার জন্য স্পেশাল সাময়িক পার্সন নম্বর তৈরী করবে। সেটি দেখতে হবে অনেকটা এইরকম 120214-TF12. এরপর এই নম্বর ব্যবহার করে বাচ্চাটি স্কুলে পড়ালেখা করতে পারবে। পরবর্তীতে সত্যিকার পার্সন নম্বর পেলে আগের সাময়িক পার্সন নম্বরটি আপডেট করে দেয়া হবে।