Select Page

সুইডেনের চাকরি জীবন

May 8, 2021 | চাকরি এবং ওয়ার্ক পারমিট, জীবন যাপন

সুইডেনে পড়তে আসা ছাত্র ছাত্রীদের প্রায় শতভাগের ইচ্ছাই থাকে ,,সুইডেনে চাকরি করার। এর বাহিরে ইতালি , স্পেন, পোল্যান্ড পর্তুগাল ফ্রান্স থেকে শুরু করে ইউরোপের বহুদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জীবনের একটি ইচ্ছা থাকে ,,যে সুইডেনে চাকরি করার।সুইডেনের চাকরি জীবন এতটাই লোভনীয় কেন ?

১. স্থায়ীভাবে সুইডেনে বসবাসের অনুমতি : সুইডেন একটি দেশ যেখানে মাত্র ৪ বছর চাকরি করার পরেই পি আর বা স্থায়ীভাবে সুইডেনে বসবাসের অনুমতি পাওয়া সম্ভব।

২. নিয়োগপত্র: বিশ্বাস করুন আর নাই করুন , সুইডেনে চাকরির নিয়োগপত্র বা চুক্তি লিখিত এমনকি মৌখিক হলেও সেটা আইন সিদ্ধ। তবে মৌখিক চুক্তিতে কাজে যোগদান করলে ,,,চাকরিদাতাকে ১ মাসের মধ্যেই লিখিত চুক্তি বা নিয়োগপত্র দিতে হবে। চাকরির নিয়োগপত্র স্থায়ী এবং অস্থায়ী হতে পারে। এছাড়া নিয়োগপত্রে আপনি কি পরিমান ছুটির সুযোগ পাবেন সেটি লেখা থাকতে হবে। আর বেতনের উল্লেখ থাকতেই হবে, তবে বেতন মাসিক হিসেবে না লিখে ঘন্টা হিসেবে লিখলেও কোনো সমস্যা নেই। এ নিয়োগপত্র পদের নাম এবং কখন কাজ করবেন ইত্যাদির তথ্য থাকতে হবে।

৩. বেতন : সর্বনিম্ন বেতন হলো ১০০ না , ৫০ না , ১০ না ,,,,,তাহলেসর্বনিম্ন বেতন হলো ০ (শূন্য) ক্রোনোর প্রতি ঘন্টায়। অর্থাৎ আপনি মাগনা চাকরি করতে পারবেন এবং সেটি আইনত বৈধ। চাকরির সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন এবং সব কিছুই ঠিক তবে বেতন দিবে না। এর সব থেকে বড় উদাহরণ হলো রেড ক্রস ধরণের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা। একে অনেক সময় ভলান্টারি চাকরি বলে। আয় না হলেও এ ধরনের চাকরি থেকে নানা সুবিধা পাওয়া যায়। তবে একটি প্যাচ আছে ,,,যেমন আপনি যদি কোনো রেস্টুরেন্টে ওয়েটার বা বাবুর্চি হিসেবে চাকরি করেন তবে ,,,বিনা বেতনে আপনাকে নিয়োগ দিতে পারবে না , সেক্ষেত্রে ন্যূনতম বেতন “লেবার ইউনিয়ন” থেকে নির্ধারিত করে দেয়া থাকে। যেমন ওয়েটার বা বাবুর্চি হলে আনুমানিক ১২৫ ক্রোনোর প্রতি ঘন্টায়। এখানে আপনার বয়স, দক্ষতা এবং কোন শহরে বসবাস করেন সেটার উপর নির্ভর করে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা হয়। যেমন
ভোলা শহরে ওয়েটার বা বাবুর্চি হলে আনুমানিক ১২০ ক্রোনোর প্রতি ঘন্টায়।
চট্টগ্রাম শহরে ওয়েটার বা বাবুর্চি হলে আনুমানিক ১২৫ ক্রোনোর প্রতি ঘন্টায়।
ঢাকা শহরে ওয়েটার বা বাবুর্চি হলে আনুমানিক ১৪০ ক্রোনোর প্রতি ঘন্টায়।

এখন মনে করেন আপনি অন্য কাজ করেন ,,,তাহলে বেতন স্কেল ভিন্ন হবে। তবে মোটামুটি ১১০ থেকে শুরু ১৫৫ ক্রোনোর পর্যন্ত সাধারণ কাজের ঘন্টাপ্রতি বেতন হয়।বয়স এবং দক্ষতা বাড়ার সাথে সাথে আপনার বেতন বাড়তে থাকবে।

৪. ছুটি: সুইডেনে চাকরি জীবিদের ছুটির সীমা পরিসীমা নেই। অনেক অনেক ছুটি আছে।
i) অসুস্থতা : আপনি জ্বর সর্দি কাশি থেকে শুরু করে কোন কারনে মন খারাপ থাকলেও চাকরি থেকে ছুটি পাবেন। কোন কারন দেখানো ছাড়াই আপনি টানা ৭ দিন অসুস্থতা ছুটি কাটাতে পারবেন। চাকরি দাতার কোনো আইনেই আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারবে না ,,,যে আপনার কি হয়েছে !!! আপনি শুধু বলবেন আপনি অসুস্থ ,,ব্যস এটুকুই যথেষ্ট। তবে ভুয়া অসুস্থ সেজে ছুটি নিয়ে ধরা খেলে মহা বিপদ। যেমন আপনি অসুস্থ হিসেবে ছুটি নিয়ে বেড়াইতে গেলেন ইতালি ,,,তাইলে ধরা !!!আপনি যদি ৭ দিনের বেশি অসুস্থ্য থাকেন তবে সুইডিশ ডাক্তারের সার্টিফিকেট লাগবে। ডাক্তার যদি ৬ মাস রেস্ট নিতে লিখে দেয় ,,তবে আপনি ৬ মাস কাজে যাবেন না। আপনার চাকরি হারানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। এবং শুধু অসুস্থতার প্রথম দিনের বেতন বাদে ,,বাকি সব দিন বা মাসের বেতন এর কমপক্ষে ৮০% বেতন পেতে থাকবেন। যারা ঘন্টা হিসেবে কাজ করেন ,,,তারাও গড়ে যত ঘন্টা মাসে কাজ করেন ,,,সেই হিসেবে বেতন পাবেন। এত স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত হিসাব লেখা সম্ভব না। তবে মোদ্দা কথা ,,,অসুস্থ্য হলে কাজে না গেলেও বেতন পাবেন।

ii) বেড়ানো: প্রতি বছর মোটামুটি এক মাস আপনি বেড়ানোর জন্য ছুটি পাবেন। এবং এটি পেইড ছুটি অর্থাৎ বেড়াতে গেলেও আপনার বেতন পাবেন। কোম্পানি এবং আইন ভেদে এই ছুটির তারতম্য আছে। এই ছুটি না কাটিয়ে কিছু দিন জমিয়ে ,,সেই পরিমান ছুটি সামনের বছরে যোগ করা যায় অথবা টাকা নিয়ে নেয়া যায়।

iii) বাচ্চা : সুইডেনে বাচ্চা থাকলে আপনি এবং আপনার স্পাউস মিলে সর্বমোট ৪৮০ দিন পেইড ছুটি নিতে পারবেন। স্বামী স্ত্রী ভাগাভাগি করে এই ছুটি নিতে পারবেন। এইসময়েও বেতন ৮০% পাবেন। এছাড়া বাচ্চা অসুস্থ্য হলে আপনি ছুটি নিতে পারবেন। ৭ দিন ডাক্তারি সার্টিফিকেট ছাড়া এবং ডাক্তারি সার্টিফিকেট দিয়ে সীমাহীন ছুটি নিতে পারবেন। এমনকি নাতি পুতি থাকলে আপনি ওই ৪৮০ দিন পেইড ছুটি নিতে পারবেন। যদি আপনার ৪ টি সন্তান হয় এবং পরে ৮ টি নাতিপুতি হয়। তবে আপনি এই আইনে ১৫ বছর পেইড ছুটি কাটাইতে পারবেন। একারনে সুইডেনে কিছু মানুষ শুধু বাচ্চা উৎপাদনেই সমগ্র সংগ্রাম করে। এটি একটি আনুমানিক হিসাব প্রকৃত হিসাবে আরো বেশি দিন ছুটি কাটাইতে পারবেন।এছাড়া চাকরি ভিসায় সুইডেনে থাকলে আপনি প্রতি বাচ্চার জন্য সরকারের কাছ থেকে মাসে ১২৫০ ক্রোনোর পাবেন। অর্থাৎ ৪ বাচ্চা থাকলে ১২৫০ গুন্ ৪ অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশী টাকা বেতনের বাহিরে এমনি এমনি সরকারের কাছ থেকে পাবেন। এটি চাকরি ভিসায় সবাই পায়।

৫. পেনশন: বর্তমান আইনে সুইডেনে পেনশনে যাবার বয়স ৬৫. তবে সামনে এই আইনের পরিবর্তন আসতেছে। পরবর্তীতে ৬৫ প্রবর্তন করে ৭০ করতে পারে। বর্তমানে শর্ত সাপেক্ষে আপনি ৬০ বছর বয়সেই পেনশনে যেতে পারবেন। আপনার চাকরির নিয়োগদাতাকে বাধ্যতামূলক ভাবেই সরকারকে কিছু টাকা দিতে হয় আপনার পেনশন বাবদ। আপনি অবসরে যাবার পরে আপনার পেনশন একাউন্টে যদি যথেষ্ট টাকা না থাকে তবে জীবন ধরনের জন্য যা টাকা দরকার তা সরকার দিয়ে দিবে। আর যদি প্রচুর টাকা থাকে তবে আপনি ইচ্ছামত খরচ করতে পারবেন। সাধারনত সরকারি পেনশনের বাহিরে আপনি আলাদা করে প্রাইভেট পেনশন কিনতে পারেন। বাস্তবতায় দেখা যায় যে ,,,অবসর গ্রহণের প্রথম ২ বছর বেশ ভালো পরিমান টাকা পাওয়া যায় ,,প্রায় বেতনের ৮০% এর পরের ৩ বছর বেতনের ৬৫-৭৫% পেতে পারেন। তবে অবসরে যাবার ৫ বছর পরে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় ,,,তখন সরকারি সাহার্য্য ছাড়া আসলে অনেকেই চলতে পারে না।

৬. কর্মঘণ্টা: সুইডেনের বেশিরভাগ চাকরির কর্মঘন্টা রুটিন দিয়ে নির্ধারিত। অর্থাৎ ৮ টা -৫ টা অফিস সময় নয়। বরং এক একজন এক এক সময়ে কাজ করেন। কাউকে কাউকে রাতে কাজ করতে হয় ,,,আবার কেউ কেউ শনি রবি ছুটির দিনে কাজ করেন। রাতে বা ছুটির দিনে কাজ করলে মূল বেতনের বাহিরে আরো অনেক টাকা পাওয়া যায়। চাকরি দাতা এই অতিরিক্ত টাকা দিতে বাধ্য। অনেক সময় দেখা যায় সপ্তাহে ৫ কর্মদিবসে কাজ করে যে টাকা পাওয়া গেছে ,,,,তার থেকে অনেক বেশি টাকা শুধু শনি রবি এই ২ ছুটির দিনেই কাজ করে পাওয়া গেছে। ফলে অনেকেই এই ছুটির দিনের কাজ বা রাতের কাজ কে বিশেষ পছন্দ করে থাকেন। আমি নিজেও ছাত্র ছাত্রীদের এই ছুটির দিনের কাজ বা রাতের কাজ করতে বলি ,,,যাতে করে সাধারন কর্মদিবসে পড়ালেখা করতে সমস্যা না হয়। কর্ম ঘন্টার বেশি কাজ করবেন না। ১০ টায় কাজ শেষ হলে ৫ মিনিট অতিরিক্ত কাজ করবেন না ,,,যদি পেমেন্ট দেয় তবে ভিন্ন কথা।ইউরোপিয়ান আইন অনুযায়ী সুইডেনে কারো সপ্তাহে গড়ে ৪০ ঘন্টার বেশি কাজ করার অনুমতি নেই। সুতরাং আইনের প্রতি আপনি এবং চাকরিদাতা সম্মান দেখাবেন আশাকরি। নতুবা ধরা খেলে সবার জন্যই বিপদ হবে।সরকারি কিছু অফিসে ইচ্ছামত সময়ে অফিস যাওয়া আসা করা যায়। একে ফ্লেক্স টিড বলে। এটির আইন কানুন ভিন্ন এবং সবাই এই সুবিধা পায় না।

৭. ইন্সুরেন্স:কাউকে চাকরি দিতে হলে সুইডিশ আইন অনুযায়ী চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মচারীর জন্য ইন্সুরেন্স বা বীমা থাকতে হবে। আপনার নিম্নের ৪ টি ইন্সুরেন্স থাকতে হবে। এগুলি হলো জীবনবীমা (liv), অসুস্থ বীমা (sjuk) , নিরাপত্তা বীমা (trygghets) এবং অবসর বীমা (pension) . এই বীমাগুলি আপনি নিজে কিনলে হবে না। এটি আপনার চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান আপনার জন্য কিনবে। ইন্সুরেন্স না কিনলে আপনি ওয়ার্ক পারমিট পাবেন না। এই ইন্সুরেন্স গুলি সুইডেনে অত্যন্ত কার্যকর। ফলে আপনি ইন্সুরেন্স এর আওতায় কিছু হলে খুব সহজেই ক্ষতিপূরন পেয়ে যাবেন।এগুলির বাহিরে নানা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আরো নানা ইন্সুরেন্স কিনে থাকে ,,,ফলে কর্মক্ষেত্রে পিছলে পরে ব্যথা পেলে অথবা ফোন চশমা ভেঙে গেলে ,,ইত্যাদির টাকাও ফেরত পাওয়া যায়।

৮. লেবার ইউনিয়ন : যে কোনো চাকরির জন্য সুইডেনে লেবার ইউনিয়ন খুব গুরুত্ব পূর্ন। আপনি ইউনিভার্সিটি এর শিক্ষক হন অথবা ট্রাক চালক সবার জন্যই আছে লেবার ইউনিয়ন। তবে সুইডেনে ভিন্ন পেশার জন্য আছে ভিন্ন লেবার ইউনিয়ন। ইনারা নানা ভাবে আপনাকে সাহার্য্য করবে। তবে এটি ফ্রি না। মাসিক ৩০০ থেকে ৭০০ ক্রোনোর আপনাকে দিতে হতে পারে। তবে আপনি খুব সহজেই এই লেবার ইউনিয়ন থেকে বছরে ৫০/৬০ হাজার ক্রোনোর বা এর থেকেও বেশি সুবিধা নিতে পারেন।সুইডেনে চাকরি করলে লেবার ইউনিয়ন এর পাশাপাশি অথবা শুধু মাত্র আ-কাসা বা বেকারত্ব ইন্সুরেন্স কিনতে পারেন। মাসে খরচ ১০০ থেকে ১৫০ ক্রোনোর। এটি অবশ্যই নিবেন। যে দিন থেকে এটি নিবেন তার ১৮ মাস পর থেকে এটি কার্যকর হবে। এর সুবিধা হলো ,,,চাকরি চলে গেলেও কমপক্ষে ২ বছর ধরে আপনার বেতন পেতেই থাকবেন। এমনকি চাকরিদাতা কোম্পানি উঠে গেলেও আপনার বেতন বন্ধ হবে না।

৯. ট্রেনিং : মানুষ যেমন ইউনিভার্সিটি তে যায় শিক্ষা নিতে ,,,,সুইডেনের কর্মক্ষেত্র অনেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত কাজ করে। জীবনমুখী শিক্ষা। সুইডেনের প্রায় প্রতিটি চাকরি ক্ষেত্রে কোম্পানির খরচে ট্রেনিং নেবার সুযোগ আছে। আর সফল ট্রেনিং শেষে প্রমোশন অথবা বেতন বেড়ে যায়। ফলে অফিসের সব থেকে নিচু পদে চাকরি করা মানুষ ১৫/২০ বছর পরে সেই অফিসের হেড হয়ে যায় ,,,এটি সুইডেনে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া এখন অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদের ব্যায়াম বা জিম করার খরচ আংশিক বা পুরোটাই বহন করে।

১০. অন্যান্য : সুইডেনের চাকরির ক্ষেত্রে আরো নানা বিধ সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। কর্মক্ষেত্রের কলিগরা ভালো বন্ধু হয়ে যায়।

সকল বিষয়